Chhotoder golpo লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
Chhotoder golpo লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

২৫ ফেব, ২০১৬

পোষা জানোয়ার

লীলা মজুমদার


আমাদের এক চেনা বাড়িতে মানু আর পানু বলে দুই ভাই, তাদের মা-বাবার সঙ্গে থাকত। 
এক বাদলা দিনে মানু পানু দেখে দুটো খুদে খুদে কুকুরছানাকে কে যেন ওদের বাড়ির সামনে, পথের ধারে ফেলে দিয়ে গেছে।
সবে চোখ ফুটেছে, কুৎকুৎ করে চাইছে। কাদা মেখে, এ ওর গায়ে উঠছে, পড়ছে; কুঁইকুঁই করে কাঁদছে। তাই দেখে ছেলেদের বড় মায়া হল। ওরা ওদের কাদা থেকে তুলে, বুকে করে, বাড়ি নিয়ে এল। সদর দরজা দিয়ে নয়। খিড়কি দোর দিয়ে ঢুকে, আগে রান্নাঘরে গিয়ে, রঘুয়ার কাছ থেকে গরম জল নিয়ে, কুকুরছানা ধুয়ে, বাসন-মোছা ন্যাকড়া দিয়ে মুছিয়ে, শুকিয়ে নিল। রঘুয়া একটা তোবড়ানো বাসনে একটু গরম দুধও দিল। ছোট ছোট লাল জিব দিয়ে ওরা কতক খেল, কতক গায়ে মাখল, কতক মাটিতে ফেলল, আবার চেটেও নিল। 
তাই দেখে ঘরের সকলে ওদের কত আদর করল। ওরাও সকলের মুখ চেটে দিল।
এমন সময় মা এসে ঘরে ঢুকলেন। ছানা দেখে তাঁর চোখ কপালে উঠল!
"এ মা! নেড়ি কুকুরের ছানা আবার কে ঘরে ঢোকাল! তোদের বাবা দেখলে রেগে যাবেন।"
ঠিক এই সময় ছানা দুটো এগিয়ে এসে, মায়ের পা চাটতে লাগল! মা তো গলে জল। দুটোকে দু হাতে তুলে নিয়ে, বাবাকে দেখাতে চললেন। 
গোড়ায় বাবা লাফিয়ে উঠেছিলেন!--"এ রাম! ছি ছি! নেড়ি কুকুরের ছানা ঘরে ঢোকাতে নেই। কুকুর চাও তো বাসুকে বলি। তার কেনেল থেকে ভালো জাতের কুকুর দেবে।"
মা বললেন, "পথে ফেলে দিলে এতটুকু ছানা কখনো বাঁচে?"
বাবা বললেন, "তবে রাখো। দেখো যেন বসবার ঘরে শোবার-ঘরে না ঢোকে।"
এই বলে কাগজ পড়তে লাগলেন। একটু আদরও করলেন না।
ছানা দুটো থেকে গেল। একটা কালোর ওপর সাদা ফুটকি। তার নাম কেলো। একটার সাদার ওপর কালো ফুটকি। তার নাম ধেলো।
তারা সারাদিন গলিতে দৌড়াদৌড়ি করে। যা দেওয়া যায়, চেটেপুটে খায়। বাড়ির লোক দেখলে নেচে-কুঁদে সারা। বাইরের লোক এলে চেঁচিয়ে পাড়া মাত। সারা রাত চটের ওপর শুয়ে, রান্নাঘরের বারান্দায় একটানা ঘুম। তবে এতটুকু আওয়াজ পেলেই সাড়া দেয়। বেশ চলেছিল মাস দুই।
তারপর একদিন বাসুকাকু এসে বললেন, "ওরে মানু পানু তোদের জন্য খাস আএক বিলিতি কুকুরের ছানা এনেছি। তাকে একবার দেখলে আর ঐ নেড়িয়েলের ছানার দিকে ফিরেও তাকাবি না। ও-দুটোকে তাড়িয়ে দে। তাহলে সেটাকে দিয়ে যাই।
বাবা কিছু বললেন না। 
মানু বলল, "তাড়ালেও যাবে না। আবার ফিরে আসবে।"
বাসুকাকা রেগে গেলেন, "খেতে না দিলে, আর এলেই লাঠিপেটা করে ভাগালে, কেমন না যায় দেখে যাবে।"
বাবা তবু কিছু বললেন না। মানু পানু ঘর থেকে চলে গেল।
রান্নাঘরের রোয়াকে, কুকুর কোলে দুজনে বসল।
মানু বলল, "তোর কত টাকা আছে রে?"
পানু বলল, "কেন, পাঁচ টাকা। তোর কত?"
মানু বলল, "আমারও তাই।"
পানু বলল, "দশ টাকা তো অনেক টাকা। চল্‌ আমরা কেলো-ধেলোকে নিয়ে পালাই।"
মানু বলল, "যত দূরে পারি। এক্ষুনি।"
পানু বলল, "তাই চল। টাকাগুলো নেব। দুটো গামছা আর ওদের গলায় বাঁধার দড়ি আর দুটো বেঁটে লাঠিও নেব। আমরা খেটে খাব, গাছতলায় শোব। ওদের আমাদের খাবারের ভাগ দেব। চল্‌।"
যেমন কথা তেমনি কাজ।
দেখতে দেখতে শহর ছেড়ে ধানক্ষেত। ধানক্ষেতের পর আম বন। সেহানে গেলে চাকরি পাবে না। তাছাড়া, বাঘ থাকলে কেলো-ধেলোকে খেয়ে নিতে পারে। পথে পথে চলাই ভালো।
এদিকে কুকুরছানারা আর হাঁটতে চায় না। একটু দূর যায়, আবার বসে পড়ে। কোলে নিয়ে হাঁটতে হয়। হাত ব্যথা করে। শেষটা কেলো-ধেলোকে গামছায় বেঁধে, পুঁটলির মতো পিঠে ঝুলিয়ে হাঁটতে হল। 
হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে, রোদ পড়ে এল। পায়ে ব্যথা করতে লাগল। কেলো-ধেলোর ওজন বাড়তে লাগল। সূর্য ডুবে গেল। আর তো পারা যায় না। তখন একটা গাছে ঠেস দিয়ে বুসে পড়ে দুজনে একটু কেঁদে নিল। তারপর ঘুমিয়েও পড়ল। পোঁটলা-বাঁধা কেলো-ধেলোকে কোলে নিয়ে। তারাও ঘুমিয়ে কাদা।
হঠাৎ চোখে-মুখে আলো পড়ল। হইচই শোনা গেল। কেলো-ধেলো পুঁটলির ভিতর থেকে মহা ডাকাডাকি শুরু করল।
কে যেন চেঁচাতে লাগল, "পাওয়া গেছে! পাওয়া গেছে! আর ভয় নেই!"
একটা গাড়ির হেডলাইটে চারদিক আলোয় আলো। গাড়ির দরজা  খুলে মা-বাবা নেমে, ছুটে এসে, কুকুরছানা আর ছেলেদুটোকে জড়িয়ে ধরলেন।
আরো কারা যেন ভিড় করেছিল। ঘুমের ঘোরে ততটা মালুম ছিল না। মা-বাবা ওদের কুকুর-কোলেই গাড়িতে তুলে, বাড়িমুখো চললেন।
ঘুমঘুম সুরে মানু বলল, "কেলো-ধেলোকে খেতে দেবে?"
মা বললেন, "না তো কী শুকিয়ে রাখব?"
"মেরে তাড়িয়ে দেবে না?"
বাবা হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে বললেন, "কেন দেব? আমাদের কি দয়া-মায়া নেই?--উঃ! গিছি! গিছি! গিছি!"
আসলে কিছুই হয়নি। বাবার কানটা মুখের কাছে পেয়ে, কুট করে কেলো একটু কামড়ে দিয়েছিল।
সে যাই হোক। এখন ওদের বাড়ি গিয়ে দেখে এসো। কেলো-ধেলো বাড়িময় ঘুরে বেড়ায়। ছেলেদের খাটের পাশে নতুন চটের উপর ঘুমোয়। ওদের চেন কলার কেনা হয়েছে। তাই পরিয়ে, হাতে একটা বেঁটে লাঠি নিয়ে, বাবা নিজে ওদের রোজ দু বেলা হাঁটান।।



১৮ ফেব, ২০১৬

মস্ত গাছ ও ছোট্ট পাখি

                    
এক ছিল মস্ত উঁচু গাছ, আর তার চারপাশে ছোট্ট ছোট্ট বাড়ি। বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে গাছ ভাবত --

                              ভয় ভাবনা নেইকো আমার কিছু।
                              সবার থেকে লম্বা আমি, সবার থেকে উঁচু।

       একদিন সকাল বেলা গাছ দেখলে , সামনের জমিটায় অনেক লোহা-লক্কড় , যন্ত্রপাতি আর লোকজন।  দেখতে দেখতে সেই লোহা-লক্কড়  দিয়ে লোকজনেরা এক প্রকাণ্ড লোহার থাম তৈরী করে ফেললে।  থামটা হল গাছের চেয়ে আরও অনেক অনেক উঁচু। 

         গাছের মনে খুব দুঃখ হল। তার ডাল বেয়ে পাতা বেয়ে তপ্তপ করে জল পড়তে লাগল।এক ছোট্ট  পাখি  সেখান দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। গাছকে কাঁদতে দেখে পাখি বললে -

                                মিথ্যে কেন ফেলছ চোখের জল ?
                                ওর  কি আছে তোমার মতো  ডাল পাতা ফুল ফল ?
                                                                                                                                                                        
গাছ বললে , তাই তো , ঠিক তো , সত্যি তো।!

                               এমনি বোকা আমি। 
                               কাঁদতে কাঁদতে মরেই যেতুম ভাগ্যি ছিলে  তুমি। 

       এই বলে, রোদের ফুলকাটা হাওয়ার রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছে-টুছে গাছ মনের আনন্দে ডাল নাচাতে লাগল, আর ছোট্ট পাখি তার ওপর বসে বসে দোল খেতে লাগল। 

 --গৌরী  ধর্মপাল --

১৪ ফেব, ২০১৬

কোকিল

               Image result for kokila bird drawing
এক কোকিল আর এক কোকিলনী। 
বসন্তকাল এসেছে। কোকিল আমগাছের দলে বসে গান গাইছে কু-উ    কু-উ    কু-উ।আর মাঝে মাঝে  কোকিলনীকে বলছে , কোকিলনী , তুই ডিম পাড়বি না ?

তিনবার চারবার এই রকম বলার পর কোকিলনী মাথা ঝাঁকিয়ে বলছে, ডিম আমার পাড়া হয়ে গেছে। 
-- কোথায়ে  পাড়লি ? কখন পাড়লি ?
--ঐ তালগাছের মাথায় কাকেদের বাসায় কাল মাঝরাতে চুপিচুপি পেড়ে এসেছি। 

শুনে তো কোকিল খুব রেগে গেছে , আর বলছে,

এঁটো কাঁতা বাসি পচা ধসা ছাড়া খায় না 
গান যদি শুরু করে কান পাতা যায় না 
একটি মাত্র চোখ --
অতি অভদ্র লোক --

সেই তাদের বাসায় তুই ডিম পেড়ে  এলি ? ঐ  নোংরা কাক-বৌয়ের তা-য়  ফুটবে আমার ছানা ? তা-ও যদি দাঁড়কাক হত। যা, ডিম ফেরত নিয়ে আয়। 
শুনে তখন কোকিলনী বলছে,

ডিম ফুটানোর কী-ই বা আমি জানি ?
যা করেছে মা-ঠাকুমা, তাই করেছি আমি। 

তখন কোকিল বললে,

তা হলে আর মিথ্যে ঘামি ?
যা করেছে বাপ-পিতমো  তাই করি গে আমি। 

বলে গাছের উঁচু ডালে গিয়ে বসল  আর গলা ছেড়ে গান গাইতে লাগল--
কু-উ  কু-উ  কু-উ  কু-উ। 

--গৌরী  ধর্মপাল --

১৩ ফেব, ২০১৬

দুই শেয়াল

                          

এক বনের মধ্যে পাশাপাশি দুই গর্তে দুই শেয়াল থাকত।  একজনের নাম একশেয়াল , আর একজনের নাম খেঁকশেয়াল। একদিন একশেয়াল খেঁকশেয়ালকে বললে -- দাদা, এ বনের চৌহদ্দি কত, তুমি জানো ?
খেঁকশেয়াল বললে , তা আর জানি না ? তোর পায়ের একশ পা চওড়া  আর আমার পায়ের একশ পা লম্বা -- এই হল এ বনের চৌহদ্দি। এক্কেবার পাক্কা হিসাব।
একশেয়াল বললে, আর বনে কত গুলো গাছ আছে, দাদা, গুনে দেখেছ ?
খেঁকশেয়াল বললে, তা আর গুনি নি ? তাহলে মাঝে মাঝে যে একা-একা ইদিক-বিদিক ঘুরে বেড়াই , সে কিসের জন্যে ?
শোন, তোর্ গায়ে যতগুলো লোম, ততগুলো গাছ।একটা কম না , একটা বেশী না। 
একশেয়াল বললে, দাদা , লোম যদি খসে ?
-- তাহলে বুঝবি, একটা গাছ খসল। 
-- আর লোম যদি গজায় ?
-- তাহলে বুঝবি গাছ গজালো।  এক্কেবারে পাক্কা হিসেব।  এদিক ওদিক হবার যো নেই। 

একদিন একশেয়াল আর খেঁকশেয়াল গর্তে ঘুমিয়ে আছে, আর বনে তো আগুন লেগেছে।  তখন খেঁকশেয়াল তাড়াতাড়ি একশেয়ালকে ঠেলা দিয়ে জাগিয়ে বলছে , ওরে আগুন আগুন ! পালা পালা পালা। 

বনের গাছপালা পুড়ছে, একশেয়াল  খেঁকশেয়াল দৌড়াচ্ছে, আর থেকে থেকে থমকে থেমে একশেয়াল বলছে, দাদা, একশ ছেড়ে দুশ হল, তিন-চার-পাঁচ-সাতশ হল, বন তো কি ফুরোল না ?  খেঁকশেয়াল বলছে, ফুরোবে বাবা ফুরোবে , তুই দৌড় না।  কুড়োতে কুড়োতে বুড়োয় , দৌড়তে দৌড়তে ফুরোয়। 

একশেয়াল  আবার দৌড়চ্ছে, আবার থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলছে --
               বন তো সাবাড় 
               গাছ তো কাবার 
               লোম তো দাদা খসছে না !
               হিসেব তো কই মিলছে না !

তখন খেঁকশেয়ালবললে , ওরে পাগলা , দেখছিস না ,

              জ্বলছে আগুন লকলকিয়ে, হিসেব পুড়ে  ছাই। 
             ভাবনা ছেড়ে দৌড়ে  আগে প্রাণ বাঁচা না ভাই।

তখন একশেয়াল  বললে, সত্যি আমি কি বোকা। 
খেঁকশেয়াল বললে , সে কথা য়্যাদ্দিনে বুঝলি ?
তারপর দুজনে মিলে  দৌড়  দৌড়  দৌড় !

--গৌরী ধর্মপাল--

১১ ফেব, ২০১৬

কচি

                                                   
পাহাড় ঘেঁষে সরল গাছের বন। সেই বনের ধারে  ফুলকো ঘাসের ঝোপে থাকে এক কচি হরিণ আর তার মা-বাবা। 
মার কোল ঘেঁষে বসে কচি দূরের  পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে আর বলে , আমরা কবে পাহাড়ে যাব মা ?
মা বলে , একটু বড় হ, পায়ে জোর হোক, দম বাড়ুক , বুদ্ধি পাকুক, তবে তো ?

একদিন কচির বাবা দূরের ঘাসবনে চড়তে গেছে , কচি মার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে একটু করে ঘাস খাচ্ছে আর একটু করে পোকামাকড় মাটি গাছপালা এসব চিনছে , এমন সময় মা হঠাত্  খাওয়া থামিয়ে কান খাড়া করে ফিসফিসিয়ে বললে, শুনতে পাচ্ছিস ?

কচি সঙ্গে সঙ্গে ঘাড়  সোজা কান খাড়া করে বললে, হ্যা মা, পাচ্ছি। কিসের শব্দ মা ?
মা বললে , এক্ষুনি দেখতে পাবি।  তার আগে আয় লুকোই। একটু পরেই গো -গো  করতে করতে আট-দশখানা মাল-বোঝাই মানুষ-বোঝাই জিপগাড়ি ধুলো উড়িয়ে পাহাড়ের দিকে চলে গেল। 
কচি বললে , ওরা কোথায়ে যাচ্ছে মা ? 

মা বললে, ওরা পাহাড়ে চড়তে যাচ্ছে। 

সঙ্গে সঙ্গে কচি 'আমিও পাহাড়ে যাব মা ' বলে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এসে গাড়ির পেছন পেছন ছুটতে আরম্ভ করলে। মা অনেক ছুটেও কচিকে ধরতে পারলে না।  কচি লাফ দিয়ে পিছনের গাড়িটায় উঠে পড়ল। 

গাড়ির লোকেরা তো কচির কান্ড দেখে অবাক।  কচিকে নিয়ে তারা কী  করবে ভাবছে, এমন সময় কচির মাকে পাগলের মত ছুটে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি  গাড়ি থামিয়ে তারা কচিকে পাঁজাকোলা করে ধরে নামিয়ে দিল। কচি খুব পা ছুড়তে লাগল , কিছুতেই নামবে না। শেষকালে একজন বন্দুক তুলে যেই না গুরুম করে আওয়াজ করেছে, অমনি কচি ভয় পেয়ে তড়াক করে লাফিয়ে পড়ে পো পা দৌড়।

বিকেলবেলা বাবা এসে সব শুনে-টুনে বললে,


                                সাহস তো তোর্ ভালই দেখছি,

                                             দৌড়সও  তো ভালই। 
                                সঙ্গে একটু বুদ্ধি জুড়লে 
                                             ফলটা হবে আরোই। 
                                কাল থেকে চল আমার সঙ্গে 
                                            যাবি  দূরের বনে। 
                                একে একে সাধ মেটাব 
                                            যা আছে তোর মনে। 
                                পুতুপুতু  করব না আর,
                                            আর না দুরুদুরু। 
                                 বারদুনিয়ায়  কাল থেকে তোর 
                                            নতুন জীবন শুরু। 

কচি বললে , হ্যা বাবা , মাও যাবে তো ?

বাবা বললে, সে কি রে ?

                          আমি যাব তুই যাবি মা যাবে না ?

                          আমি পাব তুই পাবি মা পাবে না ?
                          মা না হলে ঘুম পেলে কি হবে উপায় ?
                          শিং  দিয়ে চুলকে কে দেবে তর গায়ে ?
                          ঘাস থেকে কাঁটা বেছে দেবে কে ?
                          পাতা-গলা ঘোলা জল সেঁচে দেবে কে ?
                          মা যদি না বুড়ি হয়, বোকারাম ওরে,
                          তুই-আমি ছুটোছুটি খেলব কি করে ?


কচি তখন  'আমিও তো তাই বলছিলুম ' বলে মার কোলে মুখ লুকালো।  আর বাবার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল মা। 


                                -- গৌরী ধর্মপাল --

৯ ফেব, ২০১৬

নরহরি দাস

যেখানে মাঠের পাশে বন আছে, আর বনের ধারে মস্ত পাহাড় আছে, সেইখানে, একটা গর্তের ভেতরে একটা ছাগলছানা থাকত। সে তখনো বড় হয়নি, তাই গর্তের বাইরে যেতে পেত না।
বাইরে যেতে চাইলেই তার মা বলত,
"যাসনে! ভালুকে ধরবে, বাঘে নিয়ে যাবে, সিংহে খেয়ে ফেলবে!"
তা শুনে তার ভয় হত, আর সে চুপ করে গর্তের ভিতরে বসে থাকত।  তারপর সে একটু বড় হল, তার ভয়ও কমে গেল। তখন তার মা বাইরে চলে গেলেই সে গর্তের ভিতর থেকে উঁকি মেরে দেখত। শেষে একদিন একেবারে গর্তের বাইরে চলে এল।
সেইখানে এক মস্ত ষাঁড় ঘাস খাচ্ছিল।
ছাগলছানা আর এত বড় জন্তু কখনো দেখেনি। কিন্তু তার শিং দেখেই সে মনে করে নিল, ওটাও ছাগল, খুব ভাল জিনিস খেয়ে এত বড় হয়েছে। তাই সে ষাঁড়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
"হ্যাঁগা, তুমি কী খাও?"
ষাঁড় বলল, "আমি ঘাস খাই।"
ছাগলছানা বলল, "ঘাস তো আমার মাও খায়, সে তো তোমার মতো এত বড় হয়নি।"
ষাঁড় বলল,  "আমি তোমার মায়ের চেয়ে ঢের ঢের ভালো ঘাস অনেক বেশি করে খাই।"
ছাগলছানা বলল, "সে ঘাস কোথায়?"
ষাঁড় বলল, "ওই বনের ভিতরে।"
ছাগলছানা বলল, "আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে হবে।"
একথা শুনে ষাঁড় তাকে নিয়ে গেল।
সেই বনের ভিতরে খুব চমৎকার ঘাস ছিল। ছাগলছানার পেটে যত ঘাস ধরল, সে তত ঘাস খেল। খেয়ে তার পেট এমনি ভারী হল যে, সে আর চলতে পারে না।
সন্ধে হলে ষাঁড় এসে বলল, "এখন চলো বাড়ি যাই।"
কিন্তু ছাগলছানা কী করে বাড়ি যাবে? সে চলতেই পারে না।
তাই সে বলল, "তুমি যাও, আমি কাল যাব।"
তখন ষাঁড় চলে গেল। ছাগলছানা একটি গর্ত দেখতে পেয়ে তার ভিতরে ঢুকে রইল।
সেই গর্তটা ছিল এক শিয়ালের।
সে তার মামা বাঘের বাড়ী নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছিল। রাত্রে ফিরে এসে দেখে, তার গর্তের ভিতর কীরকম একটা জন্তু ঢুকে রয়েছে। ছাগলছানাটা কালো ছিল, তাই শিয়াল অন্ধকারের ভিতর ভালো করে দেখতে পেল না।
সে ভাবল বুঝি রাক্ষস-টাক্ষস হবে। এই মনে করে সে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল,
"গর্তের ভিতর কে ও?"
ছাগলছানাটা ভারি বুদ্ধিমান ছিল, সে বলল,
"লম্বা লম্বা দাড়ি
ঘন ঘন নাড়ি।
সিংহের মামা আমি নরহরি দাস
পঞ্চাশ বাঘে মোর এক এক গ্রাস!"

শুনেই তো শিয়াল "বাবা গো!" বলে সেখান থেকে দে ছুট! এমন ছুট দিল যে একেবারে বাঘের ওখানে গিয়ে তবে সে নিশ্বাস ফেলল।
বাঘ তাকে দেখে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, "কী ভাগনে, এই গেলে আবার এখনই এত ব্যস্ত হয়ে ফিরলে যে!"
শিয়াল হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, "মামা,  সর্বনাশ তো হয়েছে, আমার গর্তে এক নরহরি দাস এসেছে। সে বলে কিনা যে পঞ্চাশ বাঘে তার এক গ্রাস!"
তা শুনে বাঘ ভয়ানক রেগে বলল, "বটে, তার এত বড় আস্পর্ধা! চলো তো ভাগনে!তাকে দেখাব কেমন পঞ্চাশ বাঘে তার এক গ্রাস!"

শিয়াল বলল, "আমি আর সেখানে যেতে পারব না, আমি সেখানে গেলে যদি সে হাঁ করে আমাদের খেতে আসে, তা হলে তুমি তো দুই লাফেই পালাবে। আমি তো তেমন ছুটতে পারব না, আর সে ব্যাটা আমাকেই ধরে খাবে।"
বাঘ বলল, "তাও কী হয়? আমি কখনো তোমাকে ফেলে পালাবো না।"
শিয়াল বলল, "তবে আমাকে তোমার ল্যাজের সঙ্গে বেঁধে নিয়ে চলো।"
তখন বাঘ তো শিয়ালকে বেশ করে ল্যাজের সঙ্গে বেঁধে নিয়েছে, আর শিয়াল ভাবছে, "এবারে আর বাঘমামা আমাকে ফেলে পালাতে পারবে না।"
এমনি করে তারা দুজনে শিয়ালের গর্তের কাছে এল। ছাগলছানা দূর থেকেই তাদের দেখতে পেয়ে শিয়ালকে বলল--
"দূর হতভাগা! তোকে দিলুম দশ বাঘের কড়ি,
এক বাঘ নিয়ে এলি লেজে দিয়ে দড়ি!"
শুনেই তো ভয়ে বাঘের প্রাণ উড়ে গিয়েছে। সে ভাবল যে, নিশ্চয় শিয়াল তাকে ফাঁকি দিয়ে নরহরি দাসকে খেতে দেবার জন্য এনেছে।  তারপর সে কি আর সেখানে দাঁড়ায়! সে পঁচিশ হাত লম্বা এক-এক লাফ দিয়ে শিয়ালকে সুদ্ধ নিয়ে পালাল। শিয়াল বেচারা মাটিতে আছাড় খেয়ে, কাঁটার আঁচড় খেয়ে, খেতের আলে ঠোক্কর খেয়ে একেবারে যায় আর কী!
শিয়াল চেঁচিয়ে বলল, "মামা আল! মামা, আল!"
তা শুনে বাঘ ভাবে বুঝি সে  নরহরি দাস এল, তাই সে আরও বেশি করে ছোটে। এমনি করে সারারাত ছোটাছুটি করে সারা হল।
সকালে ছাগলছানা বাড়ি ফিরে এল।
শিয়ালের সেদিন ভারি সাজা হয়েছিল। সেই থেকে বাঘের উপর তার এমনি রাগ হল যে, সে রাগ আর কিছুতেই গেল না।।
 

--উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী--
 

৮ ফেব, ২০১৬

বাঘা

 
একটা ছেলে ছিল। 
সেই ছেলেটা একদিন ভাত খেতে বসে মা কে বললে , মা আমি বাঘ ভাজা খাব। 
মা বললে, বাঘ ভাজা খেতে হলে উনুন চাই এত্তো খানি, কড়াই চাই এত্তো বড়,
সরষের তেল চাই এক চৌবাচ্চা!! আমি গরীব মানুষ,এত সব কোথায় পাব বাবা?

ছেলে মুখ গোঁজ করে রইল।  অগত্যা মা বললে, আচ্ছা আমি এদিকে সব যোগাড়
দেখি গে। তুমি শিকারী বাড়ি গিয়ে বাঘের খোঁজ-খবর কর। 


ছেলেটা নাচতে নাচতে শিকারী বাড়ি  গেল। 

শিকারী সব শুনে হো-হো করে হাসতে লেগেছে, তখন শিকারীর মা এসে তাকে খুব
ধমক দিয়ে ছেলেটাকে ঘরের ভিতরে দেকে নিয়ে গিয়ে বললে, তুমি এতটুকুন ছেলে,

তুমি কি আর এতবড় বাঘ খেতে পার বাবা!! তোমার জন্য আমি একটা কচি বাঘ 
ভেজে দিচ্ছি, খুশিমতন খাও। 

এই বলে ক্ষীর ছানা এলাচ কপ্পুর দিয়ে একটি ছোট্ট বাঘ গড়ে , সেইটি ভেজে 
খোকাকে খেতে দিয়েছে। 

এদিকে হয়েছে কি.....শিকারী ঘরের পাশে এক সুড়ঙ্গের মধ্যে থাকত এক বাঘিনী 
আর তার বাচ্চা। ছেলেটা যেই পা খেয়েছে, অমনি বাঘের বাচ্চাটা বাচ্চাটা মা কে 
বলছে,মা, পা গেল, পা গেল। বাঘিনী দেখছে ,তাই তো !!

এমনি করতে করতে ছেলেটা যেই মাথা খেতে হাঁ করেছে, তখন বাঘিনী দেখলে, সব
তো যায়!!বাঘিনী এক লাফ দিয়ে পড়েছে ছেলেটার সামনে, -- দোহাই বাবা ছেড়ে দে। 



তখন ছেলেটা বললে, রোজ রাতে যদি আমাদের বাড়ি পাহাড়া দাও, আর যে চোর 
আমাদের সব চুরি করে নিয়ে গেছে, তার ঠ্যাংটি খোঁড়া করে দাও, আর বন থেকে মাযের 

রান্নার কাঠকুটো বয়ে এনে দাও, তাহলে ছাড়ব,  নাহলে নয়। 

বাঘিনী বললে, সব করব বাবা, সব করব। 

ছেলেটা তখন বাঘের মুড়ো বাঘকে ফিরিয়ে দিয়ে দিলে, আর বাঘিনীর পিঠে চড়ে বাড়ি 
এসে বললে , মা , মা, দেখে যাও!!

সেই থেকে সবাই তাকে বাঘা  বলে ডাকত।
 
--গৌরী ধর্মপাল--

৬ ফেব, ২০১৬

টুনটুনি আর দুষ্টু বিড়াল

 
                                                   

গৃহস্থদের ঘরের পিছনে বেগুন গাছ আছে। সেই বেগুন গাছের পাতা ঠোঁট দিয়ে সেলাই করে টুনটুনি পাখিটি তার বাসা বেঁধেছে।
বাসার ভিতরে তিনটি ছোট্ট-ছোট্ট ছানা হয়েছে। খুব ছোট্ট ছানা, তারা উড়তে পারে না, চোখও মেলতে পারে না। খালি হাঁ করে চিঁ চিঁ করে।
গৃহস্থদের বিড়ালটা ভারি দুষ্টু। সে খালি ভাবে "টুনটুনির ছানা খাব।" একদিন সে বেগুন গাছের তলায় এসে বলল, "কী করছিস লা টুনটুনি?"
টুনটুনি তার মাথা হেঁট করে বেগুন গাছের ডালে ঠেকিয়ে বলল, প্রণাম হই, মহারানি!"
তাতে বিড়ালনি ভারি খুশি হয়ে চলে গেল।
এমনি সে রোজ আসে, রোজ টুনটুনি তাকে প্রণাম করে আর মহারানি বলে, আর সে খুশি হয়ে চলে যায়।
এখন টুনটুনির ছানাগুলি বড় হয়েছে, তাদের সুন্দর পাখা হয়েছে। তারা আর চোখ বুজে থাকে না। তা দেখে টুনটুনি তাদের বলল, "বাছা, তোরা উড়তে পারবি?"
ছানারা বলল, "হ্যাঁ  মা, পারব।"
টুনটুনি বলল, "তবে দেখ তো দেখি, ওই  তালগাছটার ডালে গিয়ে বসতে পারিস কিনা।"
ছানারা তখনই উড়ে গিয়ে তাল গাছের ডালে বসল। তা দেখে টুনটুনি হেসে বলল, "এখন দুষ্টু বিড়াল আসুক দেখি!"
খানিক বাদেই বিড়াল  এসে বলল, "কী করছিস লা টুনটুনি?"
তখন টুনটুনি পা উঠিয়ে তাকে লাথি দেখিয়ে বলল, "দূর হ, লক্ষ্মীছাড়ি বিড়ালনি!" বলেই সে ফুড়ুৎ করে উড়ে পালাল।
 
দুষ্টু বিড়াল দাঁত খিঁচিয়ে লাফিয়ে গাছে উঠে, টুনটুনিকেও ধরতে পারল না, ছানাও খেতে পেল না। খালি বেগুন কাঁটার খোঁচা খেয়ে নাকাল হয়ে ঘরে ফিরল।

--উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী--